এনামুল হক রাশেদী, চট্টগ্রামঃ
নতুন শিক্ষা কারিকুল্যামে কোচিং প্রাইভেট নিষিদ্ধ থাকলেও চট্টগ্রাম শহরে সরকারী স্কুলের শিক্ষকরা কোচিং বানিজ্যকে তাদের আয় উপার্জনের অন্যতম উৎস করে একদিকে ছাত্র ছাত্রীদেরকে অনেকটা জিম্মি দশায় ফেলে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠছে, অন্যদিকে সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থাকে রীতিমত অনৈতিক বানিজ্যে পরিনত করেছে। এর ফলে মেধাবী শিক্ষার্থিদের অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে। অভিযোগ আছে, যেসব ছাত্র ছাত্রীরা তাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাঁছে নিয়মিত কোচিং করে তাদের প্রতি শিক্ষকদের বিশেষ একটি আনুকূল্য থাকে। যেটা ক্লাশেও ছাত্ররা সুবিধা ভোগ করে, এতে যেসব ছাত্ররা কোচিং করতে পারেনা, তারা বিব্রতবোধ করে।
অনুসন্ধানে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল, মুসলিম হাই স্কুল, চট্টগ্রাম সরকারী স্কুল সহ বিভিন্ন সরকারী স্কুলের কয়েক ডজন শিক্ষকের সন্ধান পাওয়া গেছে যারা সরকারী স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থেকেও সকাল বিকাল দুপুরে ব্যাচে ব্যাচে শিক্ষার্থীদেরকে তাদের কোচিং প্রতিষ্ঠানে শিডিউল দিয়ে ব্যস্ত রাখে। কোচিংয়ের এ শিডিউল দেওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্রদের সুবিধা অসুবিধাও বিবেচনায় আনা প্রয়োজন মনে করেনা শিক্ষকরা। বিগত মাস দেড়েক ধরে প্রচন্ড তাপদাহে যখন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, দফায় দফায় হিট এ্যালার্ট জারি করা হচ্ছিল, তখনো এসব বানিজ্যিক মানষিকতার শিক্ষকরা ছাত্রদেরকে অমানবিকভাবে কোচিংয়ে আসতে বাধ্য করেছে। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের গনিত বিষয়ের জাফর আহামদ, সুশান্ত দে ও জাহাঙ্গির, ইংরেজী বিষয়ের শাহেদ মাহমুদ ও মোঃ ফয়েজ উল্লাহ। শারিরীক শিক্ষা বিভাগের মাসুদ ইবনে আলম, আনোয়ার স্যার। এসব শিক্ষকরা সরকারী স্কুলে সরকারী বেতনভোগ করার পাশাপাশি স্কুলের আশেপাশে মাদারবাড়ী, উত্তর নালাপাড়ায় বিভিন্ন ভবনে ফ্ল্যাট ও রুম ভাড়া করে কোচিং বানিজ্য চালিয়ে মাসে মাসে অনৈতিক ও বেআইনীভাবে ছাত্রদের জিম্মি করে তাদের কাঁছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ তুলে ধরা হচ্ছে কলেজিয়েট স্কুলের গনিত বিষয়ের সিনিয়র শিক্ষক জাফর আহামদের রমরমা কোচিং বানিজ্য চিত্র।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা যায়, পুর্ব মাদারবাড়ীর শুভপুর বাসস্ট্যান্ডের পুর্বপাশে হোটেল নিরিবিলি গলিতে একটি ভবনের দোতলায় সিসি ক্যামরা লাগিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যাচের পর ব্যাচ ছাত্ররা জাফর স্যারের কোচিং আসছে যাচ্ছে। একেকটি ব্যাচ শেষ হওয়ার পর যখন ছাত্ররা বের হয়ে আসে তখন মনে হয় স্কুল ছুঠি হয়েছে। একেকটি ব্যাচে স্কুলের শ্রেনী কক্ষের মত ৫০/৬০ জন ছাত্র গাদাগাদি করে বসে স্যারের কোচিং নিচ্ছে, কোচিংয়ে আসা ছাত্রদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি ছাত্রদের থেকে ১৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০০ টাকা করে আদায় করা হয়। সে হিসাবে ৩/৪ টি ব্যাচে দেড় দুইশ ছাত্রও যদি কোচিংয়ে আসে তাহলে জাফর স্যারের প্রতিমাসে কোচিং বানিজ্যের আয় প্রায় ২/৩ লক্ষ টাকা। নাম প্রকাশ না করার স্বার্থে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানালেন সকাল ৬/৭ টা থেকে রাত ৮/৯ টা পর্যন্ত এখানে ৪র্থ/৫ম শ্রেনী থেকে ৯বম/১০ম শ্রেনীর ছাত্ররা দলে দলে ঢুক আর বের হতে থাকে। তারা এ প্রতিবেদককে উল্টো প্রশ্ন করে জানতে চান, "স্কুলের শিক্ষকরা প্রতিদিন ৩/৪ টি ব্যাচে দেড় দুইশ ছাত্রদেরকে কোচিং করানোর পর স্কুলের ক্লাশে পাঠদানে মনসংযোগ করেন কিভাবে? এসব শিক্ষকরা রোবট নাকি? স্কুলে ক্লাশ নেওয়ার পর কোচিংয়ে ছাত্রদের প্রতি মনসংযোগ করার মত মানষিকতা বা স্ট্যামিনা কতটুকু থাকে?"
এ ব্যাপারে জাফর আহামদের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে নতুন কারিকুলামে একজন সরকারী স্কুলের শিক্ষকের কোচিং করার বিধান আছে কিনা জানতে চাইলে, তিনি অনেকটা ক্ষোভ ও বিরক্তি প্রকাশ করে নতুন কারিকুল্যামে কোচিং নিষিদ্ধ স্বিকার করে বলেন, " দেখুন, আমরা তেমন বেশি ছাত্র পড়াইনা, নতুন কারিকুল্যাম অনেক ছাত্র বুঝতে কষ্ঠ হচ্ছে তাই আমি তাদেরকে হেল্প করার জন্য মুলতঃ ১৫/২০ জন ছাত্রকে পড়াই মাত্র(রেকর্ডেড)।" তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও কোচিং প্রতিষ্ঠানের প্রতি ইংগীত করে তারা স্কুল খোলে কোচিং চালাচ্ছে জানিয়ে নিজেকে সেভ করার চেস্টা করলেন।
কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাঃ সিরাজুল ইসলামের কাঁছে জানতে চাইলে তিনি জানান, " আমার স্কুলের প্রত্যেক শিক্ষককে এ ব্যাপারে সরাসরি এবং নোটিশ করে নিষেধ করা আছে, তারপরও মিডিয়া সহ বিভিন্ন দিক থেকে অভিযোগ পাওয়ার আমি সংশ্লিষ্ঠ শিক্ষকদেরকে ব্যক্তিগতভাবে ডেকে সতর্ক করেছি, তারপরও যদি গোপনে কৌশলে কোন শিক্ষক কোচিং প্রতিষ্ঠান চালানোর মত বেআইনী কার্যক্রমে জড়িয়ে থাকেন, তাহলে সে দায় তাদের নিজেদের।"
চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ন চন্দ্র নাথের কাঁছে জানতে চাইলে তিনি নতুন কারিকুল্যামে কোচিং প্রথা সম্পুর্ন বেআইনী উল্লেখ করে, এসব শিক্ষকদের প্রতি তীব্র ঘৃনা জানিয়ে প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহন করতে জেলা প্রশাসনের এডিসি শিক্ষা মহোদয়ের দৃষ্ঠি আকর্ষনের পরামর্শ দেন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(শিক্ষা ও আইসিটি) মোঃ সাদিউর রহিম জাদিদ-এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সুনিদ্দৃষ্ঠ অভিযোগ পাওয়ার পর কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহনে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহনের কথা জানান।